স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রকাশ্যে জাসদ নেতাকে কুপিয়ে খুন, একাধিক চাঁদাবাজি, সমকামিতা, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়েরকৃত ১২ মামলার আসামি জিয়াউল হক মিন্টু হয়েছেন পৌর নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী। ভোট গ্রহণের দিন (১৪ ফেব্রুয়ারি) ওই প্রার্থীর সমর্থকরা ভোট কেন্দ্র দখল করে ভোট পিটিয়ে নেবেন। এমনই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে নির্বাচনী মাঠে। ফলে পৌর এলাকার সাধারণ ভোটারদের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঘটনাটি জেলার বানারীপাড়া পৌরসভার। সরেজমিনে জানা গেছে, বানারীপাড়া পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী এ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীল, বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ মার্কার প্রার্থী রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ রিয়াজ মৃধা ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দীতা করছেন হত্যাসহ ১২ মামলার আসামি জিয়াউল হক মিন্টু। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই পৌরসভায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বানারীপাড়া পৌরসভায় দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র পদে এ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীলকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পরেও জিয়াউল হক মিন্টু স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি (মিন্টু) উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সলিয়াবাকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি (মিন্টু) ইউপি চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মাওলাদ হোসেন জানান, উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভার সিদ্ধান্তকে অমান্য করে পৌর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ইতোমধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে জিয়াউল হক মিন্টুকে বহিঃস্কার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বিদ্রোহী প্রার্থীর সাথে ঢাকায় বসে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক উপজেলার বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মাইনুল হাসান মোহাম্মদ, সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) জাহাঙ্গীর সরদার এবং সৈয়দকাঠী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মৃধাকে কেন বহিঃস্কার করা হবে না, তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই দুপুরে বানারীপাড়া উপজেলার মাদারকাঠী গ্রামের সৈয়দ আব্দুল আজিজের পুত্র সৈয়দ হুমায়ুন কবিরকে (৪০) পূর্বপরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করে জিয়াউল হক মিন্টুসহ তার সহযোগিরা। নিহত হুমায়ুন কবির ছিলেন উপজেলা জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক। নিহতের (হুমায়ুন কবির) ভাই সৈয়দ তরিকুল ইসলাম আপনুর বলেন, কোনো বিরোধ ছাড়াই প্রতিহিংসার কারণে আমার রোজাদার ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে জিয়াউল হক মিন্টু ও তার সহযোগিরা। এ ঘটনায় জিয়াউল হক মিন্টুকে প্রধান আসামি করে ১৩জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে মামলাটি বরিশাল অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। পুলিশের দায়ের করা চার্জশিটে জিয়াউল হক মিন্টু গংরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। বর্তমানে আসামিরা মামলা থেকে জামিন নিয়ে বাদি ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতিসহ হুমকি অব্যাহত রেখেছে। এছাড়াও জিয়াউল হক মিন্টুর বিরুদ্ধে বানারীপাড়া থানায় একাধিক চাঁদাবাজি, সমকামিতা, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১২টি মামলা হয়েছে। নিহত জাসদ নেতা সৈয়দ হুমায়ুন কবিরের বৃদ্ধা মা ফিরোজা বেগম মৃত্যুর আগে তার সন্তানের হত্যাকারী বর্তমানে বানারীপাড়া পৌরসভার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও একসময়ের দুর্র্ধর্ষ সর্বহারা (ক্রসফায়ারে নিহত) নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন রিপনের সেকেন্ড-ইন কমান্ড জিয়াউল হক মিন্টু, তার ঘনিষ্ঠ সহযোগি চাখার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুল ইসলাম টুকুসহ অন্যান্য আসামিদের ফাঁসি দেখে মরতে চান। নিহতের বোন আইনুন নেছা বলেন, ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) তার ভাই সৈয়দ হুমায়ুন কবির বাড়ি থেকে রোজাদার অবস্থায় জুম্মার নামাজ আদায় করতে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে (কবির) জিয়াউল হক মিন্টুসহ তার সহযোগিরা ধরে নিয়ে গিয়ে মাদরকাঠী বাসস্ট্যান্ড মার্কেটের নিচতলায় আটক করে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। মামলার তদন্তে উঠে এসেছে, ওই মার্কেটে আটক করে হুমায়ুন কবিরকে দা, হাতুড়ি ও লোহার রড দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। খুনিরা সৈয়দ হুমায়ুন কবিরের পায়ের ও হাতের রগ কেটে দেয়। হাতে ও পায়ে লোহার পেরেক ঠুকে, অন্ডকোষ থেতলে, মাথায় উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করেন। খবর পেয়ে স্বজনরা মুমূর্ষ অবস্থায় হুমায়ুনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়। পরেরদিন ২০ জানুয়ারি হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই বাদি হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৎকালীন ওসি (তদন্ত) সনজিৎ কুমার ওই বছরের ২৩ অক্টোবর জিয়াউল হক মিন্টু, মজিবুল ইসলাম টুকুসহ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আদালতের বিচারক এ পর্যন্ত মামলার ২৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন। সচেতন নাগরিকদের মতে, কোন নির্বাচনে যখন মানব হত্যার মতো ঘৃনিত মামলার আসামি প্রার্থী হয়ে জনতার কাতারে আসেন। তখন স্বাভাবিকভাবে সচেতন ও সাধারণ নাগরিকসহ ভোটারদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এমনকি ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারেও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুনীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থী এ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীল স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মিন্টুর বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে উন্নয়নের প্রতীক নৌকা মার্কার পক্ষে পৌরবাসী একাট্টা রয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। অভিযোগের বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মিন্টু বলেন, রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বিগত ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে এসব মামলাগুলো দায়ের করানো হয়েছিলো। এরমধ্যে শুধু হত্যা মামলা ছাড়া অন্যান্য মামলা থেকে আমি অব্যাহতি পেয়েছি। তিনি আরও বলেন, ভোট কেন্দ্র দখল করে ভোট পিটিয়ে নেয়ার অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। বানারীপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ হেলাল উদ্দিন বলেন, নির্বাচনী মাঠ এখন পর্যন্ত শান্ত রয়েছে। এই পরিবেশকে কেউ যেন অশান্ত করতে না পারে, সেজন্য থানা পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
Leave a Reply